কুরআন পাঠ যেভাবে হওয়া উচিত
পৃথিবীতে রাসূল সাঃ এর রেখে যাওয়া সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে আল-কুরআন। মহান আল্লাহ মানুষের হেদায়েতের জন্য পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ বলছেন, তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এবং স্পষ্ট গ্রন্থ। (সূরা মায়েদা, আয়াত ১৫)
আরেক আয়াতে আল্লাহ কুরআনকে অভিহিত করেছেন প্রমাণ বা দলিল হিসেবে। অর্থাৎ কুরআন হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের সকল বিষয়ে প্রমাণ। তাছাড়া ইসলামের সকল মৌলিক বিধানও কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে। তাই কেয়ামত পর্যন্ত কুরআন পঠিত হতে থাকবে। একজন মুসলিমের জন্য কুরআন পাঠ করা আবশ্যক। প্রতিদিন নামাযে কুরআন পাঠ করতে হয়। সেজন্য সূরা ফাতেহাসহ আরও চারটি সূরা অবশ্যই বিশুদ্ধভাবে মুখস্থ থাকতে হবে।
না বুঝে কুরআন পড়লে কি সওয়াব হবে?
সাধারণত দুই ভাবে কুরআন পাঠ করা হয়। একটা হচ্ছে কুরআন বোঝার জন্য। এক্ষেত্রে অর্থ ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। কুরআন অবতীর্ণ করার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এটি। আল্লাহ কুরআনেই বলে দিয়েছেন, আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্য। আছে কি কোনো উপদেশ গ্রহণকারী? (সূরা ক্বামার, ১৭)
এছাড়া ইবাদতের উদ্দেশ্যেও কুরআন পাঠ করা হয়। নামাযে কুরআন তেলাওয়াত করতে হয়। এমনিতেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সূরা পাঠের বিশেষ উপকার আছে। যেমন জুমার দিন সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করার কথা হাদিসে এসেছে। প্রতিদিন রাতে সূরা মুলক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর সূরা ফালাক, সূরা নাস, আয়াতুল কুরসি পড়তে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থ উদ্দেশ্য নয়, বরং আরবিতে পড়াই উদ্দেশ্য।
ইবাদতের উদ্দেশ্যে যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন অর্থ ও ব্যাখ্যা জানার প্রয়োজন হয় না। শুধু পাঠ করাই উদ্দেশ্য। কুরআনে সূরা মুযযাম্মিলে আল্লাহ বলেছেন, কুরআনকে তারতীলের সাথে পড়। তারতীল মানে কুরআনের শব্দগুলোকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করা। কুরআন ও হাদিসে কুরআন পাঠের ক্ষেত্রে তিলাওয়াত শব্দটি এসেছে। তিলাওয়াত মানে আবৃত্তি। এক্ষেত্রে অর্থ বোঝার আবশ্যকতা নেই। বরং আরবিতেই সুন্দর করে পাঠ করাকে তিলাওয়াত বলে।
অনেকে বলেন, অর্থ বোঝা ছাড়া কুরআন পড়লে কোনো লাভ নেই। এই ধারণা সঠিক নয়। রাসূল সাঃ এর একট হাদিস এর স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। তিনি বলেছেন, কুরআনের প্রতিটি হরফে দশটি করে নেকি বা সাওয়াব দেয়া হয়। আমি বলি না আলিফ-লাম-মিম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মিম একটি হরফ। (মিশকাত)
কুরআনে বিভিন্ন সূরার শুরুতে আমরা কিছু হরফ দেখতে পাই। যেমন সূরা বাকারাসহ কয়েকটি সূরার শুরুতে আছে আলিফ-লাম-মিম। এসবের কোনো অর্থ মানুষের জানা নেই। এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় না। হাদিসে রাসূল সাঃ অর্থ না জানা আয়াত দিয়ে উদাহরণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, কুরআনের অর্থ না বুঝে পড়লেও সওয়াব হবে।
কুরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ
কুরআনকে আল্লাহ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয় আমি কুরআনকে আরবী কুরআন হিসেবে অবতীর্ণ করেছি যেন তোমরা বুঝতে পারো।
আল্লাহ তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলেন হিব্রু ভাষায়, ইনজিল অবতীর্ণ করেছিলেন সুরিয়ানি ভাষায়। কুরআনের জন্য আরবি ভাষাকে বেছে নেয়ার অনেক কারণ আছে। এরমধ্যে আমরা এখানে একটি প্রধান কারণ উল্লেখ করছি।
আরবি ভাষার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, আরবি ভাষা একটি জীবন্ত ভাষা। এর মানে হচ্ছে, এই ভাষা যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিত। অন্যান্য ভাষা কয়েকশ বছরে আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়।
যেহেতু আরবি ভাষা অপরিবর্তিত, তাই কুরআন সবসময় প্রাসঙ্গিক। আরবি ভাষা যে জানবে সে কুরআন বুঝতে পারবে। কুরআন কখনো অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোর মত হারিয়ে যাবে না।
কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ বলে আরবি ভাষায়ই কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। যারা কুরআন বুঝতে চান তাদের আরবি শিখেই কুরআন বোঝার চেষ্টা করা উচিত। এমনিতে জানার জন্য অনুবাদ পড়া যায়। কিন্তু গবেষণা বা উপলব্ধির জন্য কখনোই অনুবাদের ওপর নির্ভর করা নিরাপদ নয়।
একইভাবে কুরআন তেলাওয়াতও হতে হবে আরবি থেকে। এমন অনেকে আছেন যারা আরবিতে তেলাওয়াত না করে বাংলা অর্থ পাঠ করেন। অর্থ জানার জন্য এভাবে পড়া যায়। কিন্তু তা কখনোই তেলাওয়াত নয়। আবার অনেকে আছেন যারা আরবি পড়তে অভ্যস্ত নন। কেউ হয়ত শিখেননি কিংবা সহজতার জন্য বাংলা উচ্চারণ দেখে কুরআন পাঠ করেন।
বাংলা উচ্চারণ দেখে কুরআন পড়লে যে সমস্যা
প্রথমত, বাংলা ভাষা এবং আরবি ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য। বাংলাভাষায় হিসাব করলে দেখা যাবে, আরবি ভাষার প্রায় ১৩-১৪টি বর্ণ বাংলায় নেই। তার মানে এসব বর্ণের উচ্চারণ বাংলা বর্ণ দিয়ে লেখা কখনোই সম্ভব না। আরবি ভাষার ২৮টি বর্ণমালার মধ্যে অর্ধেকই যেহেতু বাংলা ভাষায় নেই তার মানে বাংলায় যে উচ্চারণ লেখা হচ্ছে তা অর্ধেক আরবিকে তুলে ধরছে। পাঠক তা দেখে অর্ধেক অর্ধেক উচ্চারণ করতে পারছেন।
দ্বিতীয়ত, কুরআন পড়তে হলে কিছু নিয়মের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। এগুলোকে তাজউইদ বলে। তাজউইদের নিয়মগুলো বাংলা বর্ণের মধ্যে দেখানো সম্ভব না। এভাবে বাংলা উচ্চারণ দেখে যে তেলাওয়াত করা হয় তা অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিযুক্ত হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে অনেকে প্রতিবর্ণায়নের কথা বলেন। প্রতিবর্ণায়ন কখনোই অন্য ভাষার সঠিক উচ্চারণে সহযোগিতা করতে পারে না। তাছাড়া প্রতিবর্ণায়নে কোনো নির্দিষ্ট বা স্বীকৃত নিয়ম নেই। বিভিন্নভাবে লেখা হয়। বিভিন্ন রকম চিহ্ন ব্যবহার করা হয় যার সাথে পাঠক পূর্বপরিচিত থাকেন না। তাই প্রতিবর্ণায়ন উচ্চারণ শুদ্ধ করার পরিবর্তে আরও অশুদ্ধ করে তোলে।
ভুল উচ্চারণে অর্থের বিকৃতি
বাংলা উচ্চারণ দেখে কুরআন পড়াকে আলিমগণ বৈধতা দেন না। কারণ এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে অর্থের বিকৃতি ঘটে। এমনিতে নামাযের বাইরে কুরআন তেলাওয়াত করা নফল কাজ। কিন্তু কুরআন বিশুদ্ধভাবে পাঠ করা ফরজ। এক্ষেত্রে ভুল পড়ার কোনো অবকাশ নেই।
ভুল উচ্চারণে কী ধরণের সমস্যা হয় তা আমরা একটু ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করব। বাংলাভাষারই কিছু উদাহরণ আমরা লক্ষ্য করি। প এবং ফ দুটি কাছাকাছি বর্ণ। তেমনি ত আর থ এবং ব আর ভ দুটি কাছাকাছি বর্ণ। কেউ যদি এসব বর্ণ ঠিকমত উচ্চারণ না করেন অনেক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
পাকা দালানের পরিবর্তে যদি বলা হয় ফাকা দালান তাহলে ভুল বুঝবেন। তেমনি যদি কেউ থালার জায়গায় তালা বলেন কিংবা ধানের জায়গায় দান বলেন তাহলেও একই সমস্যা সৃষ্টি হবে।
সূরা ফাতিহার শুরুতে আমরা পড়ি
যার উচ্চারণ লেখা হয়, আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। এখানে আলহামদু এর হা বাংলা হ বর্ণের মত নয়। বরং এটি হচ্ছে (ح) যা গলার মধ্যভাগ থেকে উচ্চারণ করতে হয়। আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, সকল প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। কিন্তু কেউ যদি এখানে বাংলা হ বর্ণের মত করে উচ্চারণ করেন তাহলে প্রশংসা এর বদলে অর্থ হবে ছেঁড়া কাপড়। তখন পুরা আয়াতের অর্থ মহান আল্লাহর প্রতি চরম অসম্মানমূলক হয়ে দাঁড়ায়।
তেমনি বেশ কয়েকটি সূরার শুরুতে শব্দটি রয়েছে যার অর্থ ‘আপনি বলুন’। এখানে আরবি বর্ণ ق এর উচ্চারণ বাংলা ক এর মত নয়। যদি ক এর মত করে উচ্চারণ করা হয় তাহলে শব্দটির অর্থ দাঁড়াবে ‘খাও’।
এখানে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এজন্য যে আমরা এখানে উদাহরণ হিসেবে সাধারণ দুটি ভুলের কথা উল্লেখ করলাম। ভুল উচ্চারণে এমন বিকৃতিও ঘটে থাকে যাতে ঈমান চলে যাওয়ার আশংকা থাকে।
বিশুদ্ধ করে পড়ার জন্য যা করণীয়
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলাম, বাংলা উচ্চারণ দেখে কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত নয়। এটি আসলে সম্ভবও নয় এবং এতে অনেক ক্ষতির আশংকা রয়েছে। এখন পাঠকদের মনে দুটি প্রশ্ন আসতে পারে। প্রথমত, যদি উচ্চারণ দেখে পড়া জায়েয বা বৈধ না হয় তাহলে কুরআন শরীফে বাংলা উচ্চারণ দেয়া থাকে কেন?
আমরা বিনয়ের সাথে বলব, এটা আসলে ভুল কিংবা অসচেতনতা থেকে দেয়া হয়। তাছাড়া অনেকে আরবি দেশে পড়তে পারেন ঠিকই কিন্তু কখনো কখনো বাংলা উচ্চারণ দেখে সাহায্য নেন। এ উদ্দেশ্যে বাংলা উচ্চারণ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা একদমই আরবি দেখে পড়তে পারেন না তাদের জন্য বাংলা উচ্চারণ বিপদজনক।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হতে পারে, এর সমাধান কী বা ভুল থেকে বাঁচতে কী করণীয়?
আমাদের মনে রাখতে হবে, মুসলিম হিসেবে কুরআন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কুরআন শুদ্ধ করে পড়তে শেখা সবার জন্য আবশ্যক। রাসূল সাঃ বলেছেন, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয। কুরআন শুদ্ধ করে তেলাওয়াত করা এর মধ্যে একটি। রাসূল সাঃ বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সে যে কুরআন শিখে ও শেখায়। আরেক হাদিসে বলেছেন, যে কষ্ট করে কুরআন পাঠ করবে তার জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব লেখা হবে।
উল্লিখিত হাদিসগুলো আমাদের যে বার্তা দেয় তা হলো, কুরআন শেখা ও অন্যকে শেখানো অনেক মর্যাদার একটি কাজ। এমনকি কুরআন শেখার সময় যে কষ্ট করে কুরআন পাঠ করবে তার জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব আছে। সত্যি বলতে আরবি দেখেই কুরআন পড়া সহজ। এতে করে পড়া শুদ্ধ হয় এবং পাঠকের কষ্ট কম হয়।
ইসলাম যখন মদিনা থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তখন সাহাবগণ ইসলাম গ্রহণ করা ব্যক্তিদের আগে কুরআন শেখাতেন। প্রাচীন যুগ থেকে মুসলিম পরিবারের সন্তানদের আগে কুরআন শেখানোর রীতি প্রচলিত। এখনো অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদের দেখা মেলে যারা বাংলা দেখে পড়তে জানেন না তারাও কুরআন দেখে পড়তে জানেন। আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে যখন শিক্ষার এত প্রসার ছিল না তখনও মুসলিম হিসেবে তারা কুরআন বিশুদ্ধ করে পড়তে শিখেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল কুরআন সম্পর্কে সচেতনতার কারণেই।
যে কোনোকিছুর জন্য সদিচ্ছা ও সচেতনতা প্রয়োজন। কুরআন বিশুদ্ধভাবে পাঠ করার সদিচ্ছাই আপনাকে কুরআন শিখতে উদ্বুদ্ধ করবে। বর্তমানে অনেক নতুন পদ্ধতি, নতুন মাধ্যম এসেছে কুরআন শেখার। মাত্র ১০-১২ ঘন্টা সময় ব্যয় করল ঘরে বসে অনলাইনে বিনামূল্যে কুরআন শেখা সম্ভব। মুসলিম হিসেবে বিশুদ্ধভাবে কুরআন পড়ার এতটুক প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়।
লেখক: নাজমুস সাকিব


0 Comments
Do not post spam link in the comment box