নামাজ কায়েম’ বলতে আমরা কী বুঝি?







নামাজ কায়েম’ বলতে আমরা কী বুঝি?

নামাজের দাওয়াত দেয়াকে আমরা নামাজ কায়েম বুঝে থাকি। পরিবার ও সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে বলে মন্তব্য করি।
আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে ৮২বার নামাজের কথা বলেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আকিমুস সলাত বা নামাজ কায়েমের কথা বলেছেন।
আল্লাহ তায়ালা কি পরিবার ও সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠা করাকে নামাজ কায়েম বুঝিয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর সকলের খোঁজ করা দরকার।
কারণ, নামাজ পড়াটাই যথেষ্ট নয়। আল্লাহ তায়ালা নামাজের কিছু গুণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। সেগুলো প্রতিষ্ঠা করা নামাজ কায়েমের শর্ত। যেমন,
তারপর সেই নামাজীদের জন্য ধ্বংস, যারা নিজেদের নামাজের ব্যাপারে গাফলতি করে। যারা লোক দেখানো কাজ করে। (সূরা মাউন ৪-৬)
অর্থাৎ নামাজ পড়া এবং মানুষকে নামাজ পড়ালেও ধ্বংস অপেক্ষা করছে যদি কেউ নামাজে গাফেলতি করে। যত্ন না নিলে যেমন দ্রুত ক্ষয়ে যায় তেমনি নামাজের যত্ন না নিলে এটার মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়। নামাজ শুধু শারীরিক কসরত নয়। বরং এটা মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগের মাধ্যম। আল্লাহকে স্মরণ করার অপূর্ব পদ্ধতি।
অন্যকে নামাজ পড়ানো নিয়ে আমরা যে পরিমান পেরেশান থাকি তেমনটি নিজের নামাজের প্রতি থাকতে পারি না। আল্লাহ তায়ালা এই বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন।
তোমরা অন্যদের সৎকর্মশীলতার পথ অবলম্বন করতে বলো কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে যাও। অথচ তোমরা কিতাব পাঠ করে থাকো। তোমরা কি জ্ঞান বুদ্ধি একটুও কাজে লাগাও না? (সূরা বাকারা ৪৪)
এছাড়া নামাজের উদ্দেশ্য পূরণের মধ্যে নামাজ কায়েমের শিক্ষা রয়েছে। যেমন, অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব না হলে ওই ব্যক্তির নামাজ কায়েম হয় না। অর্থাৎ নামাজ কায়েম ব্যক্তির নিজের সাথে সম্পর্কিত। যেমন,
(হে নবী!) তোমার প্রতি অহির মাধ্যমে যে কিতাব পাঠানো হয়েছে তা তেলাওয়াত করো এবং নামাজ কায়েম করো, নিশ্চিতভাবেই নামাজ অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণ এর চাইতেও বড় জিনিস। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কিছু করো। (সূরা আনকাবুত ৪৫)
এই আয়াতটি কখন নাজিল হয়েছে একটু লক্ষ্য করি। সূরা আনকাবুত মক্কায় নবুয়তের প্রথম দিকে নাজিল হয়। যখন অশ্লীল ও খারাপ কাজে লিপ্ত মক্কাবাসীর মধ্যে রসূল স. দাওয়াতী কাজ শুরু করেন। এই অশ্লীলতার মোকাবেলা বস্তুগত শক্তি দিয়ে অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এর জন্য নৈতিক শক্তিই ছিল একমাত্র উপায়। আর এই নৈতিক শক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা দিলেন কুরআন পাঠ এবং নামাজ আদায়।
তবে নামাজী ব্যক্তি নিজেই যদি অশ্লীলতায় ডুবে থাকে সেক্ষেত্রে রসূল স. স্মরণ করিয়েছেন,
ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণনা করেন, নবী ﷺ বলেছেন, যার নামাজ তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি তার নামাজই হয়নি। (ইবনে আবী হাতেম)
আর নামাজ ও আল্লাহর নাফরমানী একসাথে চলতে পারে না। সুতরাং নামাজীদের নিজেদের চরিত্র ও আমলের প্রতি যত্নবান হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
নামাজ কায়েম করো এবং তাঁর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকো। তাঁরই কাছে তোমাদের সমবেত করা হবে। (সূরা আনআম ৭২)
এছাড়া সূরা মুমিনুনের প্রথম এগারো আয়াতে মুমিনদের সফলতার চমৎকার শর্তের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে দুটি শর্ত নামাজ নিয়ে। যা ব্যক্তির নিজের নামাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত হয়। (সূরা মুমিনুন ২) এবং নিজেদের নামাজগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে। (সূরা মুমিনুন ৯)
নামাজে কীভাবে বিনয়ী হতে হয় সেটাও মহান আল্লাহ শিখিয়েছেন। সূরা বাকারার ২৩৮ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
তোমাদের নামাজগুলো সংরক্ষণ করো, বিশেষ করে এমন নামাজ যাতে নামাজের সমস্ত গুণের সমন্বয় ঘটেছে। আল্লাহর সামনে এমনভাবে দাঁড়াও যেমন অনুগত সেবকরা দাঁড়ায়। (সূরা বাকারা ২৩৮)
মূলত নামাজ এমন এক নৈতিক প্রশিক্ষণ যা মানুষের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তাই আল কুরআনে বিভিন্ন বিধান বলার পরপরই নামাজের কথা স্মরণ করানো হয়েছে।
এদিকে মুনাফিকরাও নামাজ পড়ে। তাদের নামাজ কেমন হয় নিচের আয়াতে লক্ষ্য করুন।
এই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করছে। অথচ আল্লাহই তাদেরকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখেছেন। তারা যখন নামাজের জন্য ওঠে, আড়মোড়া ভাংতে ভাংতে শৈথিল্য সহকারে নিছক লোক দেখাবার জন্য ওঠে এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে। (সূরা নিসা ১৪২)
আমরা নামাজের জন্য দাওয়াত দেই, নসিয়ত করি কিন্তু নিজেদের নামাজের ব্যাপারে সিরিয়াস থাকি না। উপরের আয়াতে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে কীভাবে মুনাফিকরা লোক দেখানো নামাজ পড়ে। তাই নামাজে সময় মতো মসজিদে উপস্থিত হওয়া, বিনয়ের সাথে নামাজ পড়া ইত্যাদি বিষয়ে আরো বেশি সিরিয়াস হতে হবে।
মূলত নামাজ হতে হবে শুধুমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এর বাইরের কিছু গ্রহণীয় হবে না।
বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদাতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য। (সূরা আনআম ১৬২)
উপরের আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, ‘নামাজ কায়েম’ ব্যক্তির নিজের সাথে সম্পর্কিত। নিজের নামাজ ভালো হওয়া একজন মুসলিমের বেসিক উপকরণ। এর ওপর ভিত্তি করে তার চরিত্র, দাওয়াতী চেতনা ও কর্মপদ্ধতি নির্ভর করে। তাই ব্যক্তিগত নামাজের ব্যাপারে আমরা আরো যত্নবান হবো ইনশাআল্লাহ।
এদিকে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, নামাজ কায়েম মানে শুধু নিজের নামাজের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। নামাজের জন্য দাওয়াত দেয়া জরুরি নয়। কিন্তু এরকম চিন্তা করা ইসলামের সাথে সাংঘার্ষিক। কারণ আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে বলেছেন,
নিজের পরিবার পরিজনকে নামাজ পড়ার হুকুম দাও এবং নিজেও তা নিয়মিত পালন করতে থাকো। (সূরা ত্বহা ১৩২)
লুকমান আ. তার পুত্রকে নামাজের হুকুম দিয়েছিলেন। তিনি ছেলেকে যা বলেছিলেন আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে সেটা উল্লেখ করেছেন।
হে পুত্র! নামাজ কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যা কিছু বিপদই আসুক সেজন্য সবর করো। একথাগুলোর জন্য বড়ই তাকিদ করা হয়েছে। (সূরা লুকমান ১৭)
তাই নিজের নামাজের প্রতি যেমন যত্নবান হতে হবে একই সাথে পরিবার, স্বজন, আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতসহ সবাইকে নামাজের জন্য ডাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পরিবার সাথে নিয়ে নামাজের আমল করার তৌফিক দিন।

যেভাবে নামাজে ভালো করা যায়

১. ভালো নামাজী হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। খুশু খুজু অর্জন রাতারাতি সম্ভব নয়। এজন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যেতে হবে।
২. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করার অভ্যাস করা দরকার। এজন্য দরকার সুন্দর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। যেমন ফজরের নামাজ পড়তে হলে অবশ্যই রাতে আগে ঘুমাতে হবে। এতে ভোরে ঘুম থেকে উঠা, ধীর্ স্থিরভাবে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়।
৩. ব্যস্ত অবস্থায় নামাজে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। এজন্য একটু আগে থেকে নামাজের জন্য অযু করা এবং আনুসঙ্গিক প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
৪. সুন্দর পোশাকে নামাজে দাঁড়ানো দরকার। এটা মনে করা দরকার যে আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়াচ্ছি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বনী আদম! প্রত্যেক ইবাদাতের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও।’ (সূরা আরাফ ৩১)
৫. নামাজে যা পড়া হয় সেগুলোর অর্থ আমরা বুঝি না। তাই নামাজে পড়া সূরা, তসবি ও দু’আগুলোর অর্থ ব্যাখ্যাসহ জানা দরকার। নামাজের সময় যা পড়ছি তা খেয়াল করতে হবে।
৬. নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন সেটা স্মরণ করা দরকার। এতে নামাজ কায়েম পূর্ণতা পাবে ইনশাআল্লাহ।
সর্বোপরি, নিজ পরিবারসহ সবাইকে নামাজ পড়ার দাওয়াত দিতে হবে। তবে নামাজ কায়েম মানে হচ্ছে, নামাজের সকল গুণাগুণ বজায় রেখে নামাজ পড়া এবং নামাজের শিক্ষাগুলো বাস্তব জীবনে আমল করা।

Post a Comment

0 Comments