শির্কের ভয়বহতা
-------------------------
.
.
শিরক হল তাওহীদের বিপরীত। তাওহীদ হল আল্লাহর একত্ববাদ। অর্থাৎ আল্লাহর হকসমূহ তথা যেসকল বিষয় এককভাবে কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট তা আল্লাহকেই প্রদান করা। যেমনঃ ইবাদত, আনুগত্য ইত্যাদি। এর বিপরীত হল শিরক। শরীক করা, অংশীদার সাব্যস্ত করা। অর্থাৎ আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট কোন এক বা একাধিক বিষয়কে আল্লাহর পাশাপাশি বা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কাউকে প্রদান করা।
.
নিচে শিরকের কিছু ভয়াবহ দিকের প্রতি আলোকপাত করা হলঃ
.
.
১. শিরক সবচেয়ে বড় পাপ
---------------------------------------
.
وَاِذۡ قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِهٖ وَهُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِكۡ بِاللّٰهِ ؕؔ اِنَّ الشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ
স্মরণ কর, যখন লুকমান তার ছেলেকে নসীহত ক’রে বলেছিল- হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শিরক কর না, নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় যুলম। [সূরাঃ লুকমান ৩১:১৩]
.
وَمَنۡ یُّشۡرِكۡ بِاللّٰهِ فَقَدِ افۡتَرٰۤی اِثۡمًا عَظِیۡمًا
যে আল্লাহর সাথে শরীক করল, সে এক মহা পাপ রচনা করল। [সূরাঃ আন নিসা ৪:৪৮]
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, এক লোক রসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ্র কাছে সর্বাধিক বড় গুনাহ কোনটা? রসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহর সাথে কাউকে শারীক করা। অতঃপর পুনরায় সে জিজ্ঞেস করলো, তারপর কোনটা? তিনি (সা) বললেন, তোমার সন্তান তোমার সাথে খাবে- এ ভয়ে তাকে হত্যা করা। পুনরায় প্রশ্ন করলো, তারপর কোনটা? তিনি (সা) বললেন, তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা।
.
তিনি [ইব্নু মাসঊদ(রাঃ)] বলেছেন, এর সমর্থনে আল্লাহ তা’আলা (কুরআনে) অবতীর্ণ করলেন: “তারাই আল্লাহর প্রকৃত বান্দা, যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে মা’বূদ হিসেবে গণ্য করে না,আল্লাহ যাদের হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন, আইনের বিধান ছাড়া তাদের (অন্যায়ভাবে) হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। আর যে এগুলো করে সে শাস্তির সাক্ষাৎ লাভ করবে”।– (সূরাহ আল ফুরকান ২৫ : ৬৮)।
ফুটনোটঃ
সহীহ : বুখারী ৬৮৬১, মুসলিম ৮৬, নাসায়ী ৪০১৩, আবূ দাঊদ ২৩১০, তিরমিযী ৩১৮২, ইরওয়া ২৩৩৭, সহীহ আত্ তারগীব ২৪০৩।
.
মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৪৯
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
.
.
২. আল্লাহ্ শির্কের গুনাহ ক্ষমা করেন না
-----------------------------------------------------------
.
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
.
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া অন্যসব গুনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে লোক আল্লাহ্র সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করল, সে যেন মহা অপবাদ আরোপ করল।” (সূরাঃ নিসা ৪: ৪৮)
.
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া অন্যসব গুনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে লোক আল্লাহ্র সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করল, সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হল।” (সূরাঃ নিসা ৪:১১৬)
.
এখানে মনে রাখতে হবে, এই আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে কেউ যদি আল্লাহর সাথে শির্ক করা অবস্থায় মারা যায়, তাহলে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করবেন না। সে চিরকালের জন্য জাহান্নামের অধিবাসী হবে। কিন্তু যদি মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতে থাকতেই তওবা করে ইসলামে ফিরে আসে তাহলে আল্লাহ্ তার তওবা কবুল করে তাকে ক্ষমা করে দিবেন। যেমনঃ সাহাবী (রা) দের অনেকেই ইসলামপূর্ব জীবনে মুশরিক ছিলেন। কিন্তু ইসলামে ফিরে আসার পর তারাই উম্মহর শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হন।
.
হাদিসে এসেছেঃ
.
আনাস ইবনু মালিক (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, মহান আল্লাহ্ বলেনঃ হে আদম সন্তান! যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার নিকট (ক্ষমা পাওয়ার) আশা করতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমার গুনাহ ক্ষমা করতে থাকব, তোমার গুনাহ যত অধিক হোক না কেন, এতে আমি পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশের কিনারা বা মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তারপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করব, এতে আমি পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়েও আমার নিকট আস এবং আমার সাথে কোনকিছু শরীক না করে থাকো, তাহলে আমিও এই পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব। [সহীহ আত্-তিরমিযীঃ ৩৫৪০, রিয়াদুস সালিহীনঃ ৪৪৭]
.
.
৩. শির্ক করলে পূর্বের সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যায়
---------------------------------------------------------------
.
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
.
“(হে মুহাম্মহ (সা)) আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের পতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আপনি শির্ক করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” (সূরাঃ যুমার ৩৯:৬৫)
.
আল্লাহ্ পূর্ববর্তী নবীদের কথা উল্লেখ করে বলেনঃ
.
“এটি আল্লাহর হেদায়েত। নিজ বান্দাদের মধ্যে তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়াত দান করেন। যদি তারা শির্ক করত, তবে তাদের যাবতীয় কর্ম নিষ্ফল হয়ে যেত।” (সূরাঃ আল-আনআম ৬:৮৮)
.
শির্ক করলে নবীদের আমলই যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমাদের আমলের অবস্থা কি হবে তা বলাই বাহুল্য।
.
.
৪. যে ব্যাক্তি শির্ক করে তার জন্য জান্নাত হারাম
----------------------------------------------------------
.
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
.
“নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেবেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম।” (সূরাঃ আল-মায়েদা ৫:৭২)
.
অর্থাৎ কেউ যদি মুশরিক অবস্থায় মারা যায়, তাহলে তার জন্য জান্নাত চিরদিনের জন্য হারাম।
.
.
৫. নবী ও মুমিনদের জন্য মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা জায়েজ নয়
--------------------------------------------------------------
.
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
.
“নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, যদিও তারা নিকট আত্নীয় হোক যখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে তারা জাহান্নামী।” (সূরাঃ তওবা ৯:১১৩)
.
“যখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে তারা জাহান্নামী” অর্থাৎ যখন কোন ব্যক্তি মুশরিক অবস্থায় মারা যায়, তখন তার নাজাত বা মুক্তির জন্য কোন দু’আ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু জীবিত অবস্থায় কাফের মুশরিকদের জন্য আল্লাহ্র নিকট তাদের হেদায়েতের জন্য দু’আ করা যাবে।
৬. মুশরিকরা অপবিত্র
-------------------------------
.
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
.
“হে ঈমানদারগণ, মুশরিকরা তো অপবিত্র।” (সূরাঃ তওবা ৯:২৮)
.
এখানে অপবিত্রতা বলতে কুফর ও শিরকের অপবিত্রতা বুঝানো হয়েছে।
.
.
৭. মুশরিক ব্যক্তির রক্ত (তথা প্রাণ সংহার) ও ধন-সম্পদ কেড়ে নেয়া উভয়ই হালাল।
---------------------------------------------------------------
.
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
.
“অতঃপর মুশরিকদেরকে হত্যা কর যেখানে তাদের পাও, তাদেরকে বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক।” (সূরাঃ তওবা ৯:৫)
.
হাদিসে এসেছেঃ
.
“আবু হুরায়রাহ্ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে, আর আমার প্রতি এবং আমি যা (দ্বীন ও শরীয়াহ্) নিয়ে এসেছি তার প্রতি ঈমান আনে। আর যখন তারা এ কাজ করল, আমার হাত থেকে তাদের জান ও মাল বাঁচিয়ে নিল। অবশ্য অপরাধ করলে আইনের বিধান তার উপর কার্যকর হওয়া স্বতন্ত্র কথা। তার (আখিরাতের) হিসাব-নিকাশ আল্লাহ্র উপর ন্যস্ত।” [সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিসঃ ২৫, ২৯৪৬ সহীহ মুসলিম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা, হাদিসঃ ৩৩-৩৯]
.
অর্থাৎ ইসলামিক রাষ্ট্রের খলিফা বছরে একবার কিংবা দুবার পার্শ্ববর্তী কুফর রাষ্ট্রে মুজাহিদ বাহিনী পাঠাবে। তারা সেখানে গিয়ে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবে। যদি তারা তা মেনে নেয়, তাহলে তো তা তাদের নিজেদের জন্যই কল্যাণকর। আর যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তবে জিযিয়া দিয়ে ইসলামিক রাষ্ট্রের অধীনে ইসলামিক শাসনাধীনে থাকবে। তাতেও রাজি না হলে তাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করে তাদেরকে হত্যা করা হবে। তাদের নারী ও শিশুদেরকে দাস দাসী বানানো হবে। তাদের ধনসম্পদ গণীমতের মাল হিসেবে গণ্য হবে।
.
.
সুতরাং আল্লাহর নিকট এই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় ও জঘন্য পাপ যা ঈমান ও আমলকে ধ্বংস করে দেয়। মানুষকে ইসলামের গন্ডি থেকে বের করে মুশরিক বানিয়ে দেয়। তাই শিরক মুক্ত ঈমান ও আমলেই রয়েছে প্রকৃত নাজাত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা বলেনঃ
.
اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَلَمْ يَلْبِسُوْۤا اِيْمَانَهُمْ بِظُلْمٍ اُولٰٓئِكَ لَهُمُ الْاَمْنُ وَهُمْ مُّهْتَدُوْنَ
.
"যারা ঈমান এনেছে আর যুলম (অর্থাৎ শিরক) দ্বারা তাদের ঈমানকে কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা লাভ তারাই করবে আর তারাই হল সঠিক পথপ্রাপ্ত।" [সূরা আল-আনআম ৬ঃ৮২]
.
সহীহ হাদিস অনুযায়ী এ আয়াতে উল্লেখিত যুলুম শব্দের অর্থ হল শিরক। অর্থাৎ যারা শিরক বিহীন ঈমান নিয়ে মরতে পারবে তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং পরকালে নাজাতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

0 Comments
Do not post spam link in the comment box